Wednesday, September 29, 2010

রক্তের স্বাদ

আমার বন্ধুরা আমায় কেটে কুটে নিয়েছে
তরবারির আগা আমার পেটে বিঁধেছে
আমার মস্তক নিচিহ্ন
দেহ খন্ডিত
---হাত জোড়ার গোড়া কর্তন করে
---পা জোড়াও নিল বস্তা ভরে
রক্ত ধারা জমাট বেঁধে আছে বিছানা ও বালিশে।

তাজা রক্ত, লবণাক্ত
ওরা পান করেছে
আমিও দু'ফোটা পিয়েছি।

নিজাম কুতুবী'র ছোট গল্প - "ইঁদুর খাওয়া মজুর দল"

বাংলাদেশের মানুষ এক সময় আরাকান রাজ্যে দিন মজুরের কাজ করতে যেত। কখনোবা দল বেঁধে কখনোবা একা একা। একবার কুড়ি জনের একটি দল ফসল ঊঠানোর ঋতুতে আরকান রাজ্যে গেল দিন মজুরের কাজ করতে। ওই দলটি এক মগ রাজার কাছে ধান কাটার কাজ নিল। বেতনের কথা ঠিক করল এভাবে, 'মগ রাজার জমিনের ধান কেটে তার গোলায় তুলে দিতে হবে, বিনিময়ে এক সাথে কিছু অর্থ দেওয়া হবে, খাওয়া-দাওয়া নিজেদের।"

তখন আরাকানের এক দুই পয়সাও বাংলাদেশের জন্য অনেক মুল্যবান। মজুরেরা সারাদিন কাজ করে নিজেদের খাবার নিজেদের টাকায় নিজেরা রান্না করে খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। আরকান রাজ্যে তখন মুরগি, গরু সহ বিভিন্ন গোস্তের চড়া দাম ছিল। মাছও মিলত খুব কম। তাই মজুরের দলটি কিভাবে দু'চার পয়সা বাচাঁনো যায় এবং খাবারও মজা করে খাওয়া যায় তাই নিয়ে পরামর্শে বসল। সর্ব শেষে সিদ্ধান্ত হল এই, "ধান কাটার সময় ছোট-বড় যেসব ইদুঁর পাওয়া যাবে তাই তারা রান্না করে খাবে। এতে অনেক গুলো টাকাও বাচঁবে মজা করে খাওয়াও যাবে।"
কিন্তু মজুরদের মাঝে 'কথিত গবেট' নামের এক জোয়ান ছাওয়াল ছিল সে দলের উনিশ জনের ইদুঁর খাওয়ার সিদ্ধান্তটি মেনে নিতে পারলা। সে এর বিপক্ষে গিয়ে এর প্রতিবাদ করে বলল, "প্রয়োজনে আম গাছ, কাঁঠাল গাছের পাতা খাব, ঘাস খাব তবু ইঁদুরের গোস্ত খাব না, এবং তোমরা পয়সা বাঁচানোর জন্যে ইঁদুর মারা গোস্ত খাচ্ছ তাও দেশে গেলে তোমাদের বউ বাচ্ছা ও পাড়া পড়শিদের জানিয়ে দেবো।"

সে উনিশ জনের দল থেকে বিচ্ছন্ন হয়ে নিজেই নিজের খাবার জোগাড় করে খেতে লাগল। উনিশ জনের মজুর দলটি 'কথিত গবেট' মজুরটিকে অনেক করে চেষ্টা করেও তাদের দলে ভিড়াতে পারলনা এবং দেশে গেলে একথা কাউকে না বলার প্রতিশ্রুতিও নিতে পারলনা। বরং 'কথিত গবেট' আরো চরমে গিয়ে এক পায়ে খাঁড়াই রইল যে, উনিশ জনের ইঁদুর খাওয়ার বিষরটি সে দেশে গেলে তাদের বউ-বাচ্ছা ও পাড়া পড়শিদের জানিয়ে দেবে।

শেষে উনিশ মজুরের দলটি চিন্তায় পড়ে গেল! কি করা যায় এই গবেট'টাকে নিয়ে!! দলেও ভিড়াতে পারলনা, বারণ করেও লাভ হলনা!!! তারা উনিশ জনেই প্রতিদিন চর্বি ওয়ালা মোটা মোটা বেড়াল সমান ইয়া বড় ব-ড় ইঁদুর সাবাড় করেই চলল। পয়সাও বাচাঁল, মজা করেও খেল।

অনেক দিন পর কাজ শেষে মজুর দলটি দেশে ফিরে এল। ওই 'কথিত গবেট' বেচারা ভাবল, ঘরে গিয়ে সবার সঙ্গে দেখা করে খেয়ে-দেয়ে পাড়ার রাস্তায় বের হবে। আর এই ফাঁকে আগে থেকেই দলবদ্ধ ও পরামর্শ করে থাকা উনিশ জনের মজুর দলটির এক এক জন এক এক দিক থেকে আগে ভাগে গ্রামে এসে সবাইকে উল্টো ভাবে 'কথিত গবেট' বেচেরার ইঁদুর খাওয়ার ঘটনা বলে যাচ্ছে,,,,

"ওই 'গবেটটা'কে আমরা উন্নিশ জনেই কয়েছি যে, ইঁন্দুরের গোস্ত খাসনে। দ্যাশে গেলে মানসে কি কবে? দু'পয়সা বাঁচনের জন্যে ইঁন্দুরের গোস্ত খাতে হয়! প্রয়োজনে ঘাস খা, আম পাতা-কাঁঠাল পাতা খা। গবেট'টা কারো কথাই খোনল না।"
এভাবে সারা গ্রাম হয়ে গেল 'কথিত গবেট' এর ইঁদুরের গোস্ত খাওয়া না খাওয়ার কিচ্ছা।
সকাল বেলা 'কথিত গবেট' বেচারা যখন রাস্তায় বের হল দেখল তার চারপাশ থেকে পাড়ার লোকেরা তাকে তার দু'পয়সা বাঁচানোর জন্যে ইঁদুরের গোস্ত খাওয়ার কিচ্ছা শুনাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত 'কথিত গবেট' বেচারা তার জামার আস্তিনে মুখ লুকাল এবং ভাবল... "এই ইঁদুরের গোস্ত খাওয়া উনিশ জনের দলটি সত্য-মিথ্যা মিথ্যা-সত্যে যে ভাবে বদলিয়ে দিল। এভাবে বদলালে এই বাংলা সেই বাংলাই রয়ে যাবে যে বাংলায় নবাব সিরাজউদ্দৌল্লাকে তার নিজের আস্তিনে লুকিয়ে থাকা চাটুকাররাই দংশন করেছিল। আজো ওই প্রেত মুক্ত হতে পারল না বাংলা। আমরা বদলাবো কি ভাবে? বদলাতে হলে আদর্শের প্রয়োজন, গুণের প্রয়োজন। এই আদর্শটাকে যদি আমরা না চিনি, না বুঝি নিজেকে কিভাবে গুণে গুনান্বিত করা যায়! নিজেদেরকে মনে করি আমরা ভেড়া-বকরির দল তাহলে পরিবর্তনটা কে কাকে করবে?

'কথিত গবেট' বেচারা এসব ভাবতে ভাবতে নিজেই নিজের পথে চলছে...
এবং বলছে...
যদি তুর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে...

Monday, September 6, 2010

নিজাম কুতুবী'র ছোট গল্প ==="হায়েনা"

একবার একটি হায়েনার ইচ্ছে হয়েছিল মানুষের সঙ্গে বসবাস করতে। হায়েনাটি মানুষের মত করে মানুষের রূপে মানুষের শহরে বসবাস পাততে চেয়েছিল। হায়েনাটি সেই উদ্দেশ্যে পাতাল পুরি থেকে হাজার মাইল পথ-ঘাট-নদী মাঠ পেরিয়ে হাজির হলো একটি মানুষের শহরে।

এই শহরে এসে সে দেখতে পেলো, কিছু মানুষ একজন মানুষের পদার্পনের অপেক্ষা করছে। লোকটির আগমনের বার্তায় ফুলের পাঁপড়ি ছিটাচ্ছে তার পদপ্রান্তে। ঠিক এমুহুর্তে হাজির হলো একটি লাল মোটর কার। চারদিক থেকে চারজন ছুটে এসে দরজা খুলে দিল। লাল মোট গাড়ি থেকে বের হলো লাল পোশাকে আচ্ছাদিত একটা লাল মানুষ। হায়েনাটির মনে হলো, মানুষটির পরনে কোন কাপড় নেই। তার কোন হৃদয়ও নেই। হয়ত মানুষটি কোন দিন সূর্যের আলো দেখেনি। জোøারাতও তার নজর কাড়েনি। চাঁদের আলোয় ভেজেনি তার শরীর। মানুষটি হেঁটে হেঁটে একটি বিরাট অট্টালিকায় প্রবেশ করলো যা আকাশ ছুঁয়েছে। মানুষটা একটা উঁচু আসনে বসলো যা মানুষের হাড় আর খুলি দিয়ে তৈরী।

আরো একটু পরে হায়েনাটি একটা রোমহর্ষক দৃশ্য দেখল। অট্টালিকার ভেতর একটা খুঁটিতে একজন মানুষ বাঁধা আর পাশেই রাম-দা হাতে দাঁড়িয়ে আছে আর একটা মানুষ। মানুষটা রাম-দার এক কোঁপে বাঁধা লোকটার একটা হাত বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। আকাশ বাতাস কেঁপে উঠলো তার আর্তচিৎকারে। কাটা হাতের দিকে তাকিয়ে লাল মানুষটা তা কামড়াতে শুরু করল। হায়েনাটি ভয়ার্ত চোখে দৃশ্যটি দেখে নিজের মনে বলে উঠল, “আমার অনেকদিন মাংস খাওয়া হয়নি, আর এখানে মানুষ মানুষের মাংস খাচ্ছে...।”

হায়েনাটি অস্থির হয়ে ছুঁটতে লাগল। ছুঁটতে ছুঁটতে থমকে দাঁড়ালো মাঝপথে-কতগুলো মানুষ একজন লম্বা চুলের মানুষকে রাস্তা দিয়ে টেনে হিচঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে। লম্বা চুলের মানুষটার বসন আলগা হয়ে পড়েছে। কালো পিচের রাস্তায় বয়ে গেছে রক্তের চোপ। লম্বা চুলের মানুষটার আর্তনাদ ঢেকে গেলো মানুষগুলোর আদিম উল্লাসে। হায়েনাটির প্রাণ হাঁসহাঁস করতে লাগল। সে প্রাণপণে ছুঁটতে লাগল। তার চোখে বিস্ময় ও প্রশ্নের চিহ্ন। শহরের শেষ প্রান্তে এসে হায়েনাটি নিজের দাঁত দিয়ে মাটি খুঁড়তে লাগল। এবং একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “আমার স্বজাতি অনেক উত্তম ছিল। এসব দানব মানুষদের র্কীতিকলাপ দেখে বেঁচে থাকতে লজ্জা হচ্ছে...। তাই কবর খুঁড়ছি।”